শামবালা
শামবালা' কোন মিথ নয়, তা এক দিব্যজ্যোতির্ময় নগরী (City of Light)। দ্বিতীয় মন্বন্তরের সময় শামবালা নগরীর সৃষ্টি হয়। যদিও এই নগরী আমাদের পৃথিবীতেই অবস্থিত, তবে সাধারণ চর্মচক্ষে তা দেখা যায়না,কারণ একটি অতিসূক্ষ্ণস্তরে এই নগরী অবস্থান করে। আর্যাবর্ত্য উপত্যকায় একটি ভাসমান দিব্যআলোক পূর্ণ গোলকের মধ্যে ভূমিযুক্ত শামবালা নগরী অবস্থিত। অতীতে গোবি মরুভূমির মধ্যে এর অবস্থান ছিল এবং বর্তমানে ভুটান অঞ্চলে শামবালা নগরী অবস্থান করছে।
সৃষ্টির সময়ে শামবালা নগরী প্রথমত ঋষিগণের জন্যই নির্দিষ্ট ছিল, কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরবর্তীকালে অবতারগণ, দেব-দেবীগণ এবং বিশেষ মহাত্মাগণের অবস্থানের জন্য এই নগরী নির্ধারণ করা হয়, যাতে তাঁরা এখানে অবস্থান করে বিশেষ বিশেষ দিব্যউদ্দেশ্য সাধন করতে পারেন। শামবালা নগরী সৃষ্টির পর মার্কন্ডেয় মহাঋষি অন্যান্য মহাঋষিগণকে এই দিব্যনগরীতে স্থায়ীভাবে বাস করার জন্য পরিচালিত করেন। শামবালা নগরীতে বসবাসকারী দিব্যাত্মাগণের সর্ববিধ কাজের পরিচালনার জন্য সেখানে কর্তৃপক্ষ চয়নের সময় এলো। পরম দিব্যাত্মাগণের হাতে শামবালা নগরীর পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করা হলো। এই পরম দিব্যাত্মাগণ শামবালা নগরীর "মৈত্রেয়" হিসেবে পরিগণিত হলেন। শামবালা নগরীতে পাঁচ থেকে ছয় জন মৈত্রেয় রয়েছেন; যাঁদের মধ্যে রয়েছেন প্রভু মৈত্রেয় স্বয়ং যিনি শামবালার রাজা এবং অবশ্যই শ্রীকল্কিদেব। প্রভু শ্রীকল্কি শামবালা নগরীর সর্বোচ্চ মৈত্রেয় এবং তিনি তাঁর সঙ্গে সংযুক্ত সকল মহাত্মা ব্যক্তিগণকে নির্দেশ দিয়ে থাকেন। শামবালা নগরীর মৈত্রেয়গণ ভিন্ন ভিন্ন কাজের দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে সেগুলির পরিচালনা করেন, যার মধ্যে আমাদের পৃথিবীর দায়িত্বভারও তাঁদের উপর ন্যস্ত।
শামবালা কোন ধর্মের নিজস্ব নয়। আমরা এই পার্থিব জগতে বাস করেও শামবালা জগতের নিয়ম অনুসরণ করে শামবালার অধিবাসী হয়ে উঠতে পারি। পৃথিবীতে মানুষ যত বেশি নিজেকে সত্যাশ্রয়ী রূপান্তরের পথে আনতে পারবে, ততই শামবালা এবং আমাদের এই পার্থিব জগতের ব্যবধান কমে আসবে। সমগ্র পৃথিবী হয়ে উঠবে শামবালার পথ, যা আমাদের সুবর্ণযুগ বা সত্যযুগে পৌঁছে দেবে। সত্যযুগে, সমগ্র পৃথিবী হয়ে উঠবে 'শামবালা'।
শামবালা নগরী গড়ে ওঠার ইতিকথা
দেবাদিদেব মহাদেবের কাছ থেকে পাওয়া বরে মার্কণ্ডেয় মহাঋষি প্রলয়ের হাত থেকে রক্ষা পান। প্রলয়কালে জলে পরিপূর্ণ অন্ধকার পৃথিবীতে হাজার হাজার বছর কাটানোর পর , একদিন মার্কণ্ডেয় মহাঋষি দেখলেন একটি নীল-বর্ণের দিব্যশিশু একটি পত্রের উপর ভাসমান অবস্থায় রয়েছে। দেখামাত্রই শিশুটি যে আসলে কে, সেই বিষয়ে তিনি জ্ঞানপ্রাপ্ত হলেন। শ্যামবর্ণের এই শিশুটি স্বয়ং ছিলেন প্রভু শ্রীবিষ্ণু। এরপরই শ্রীবিষ্ণু মার্কণ্ডেয় মহাঋষির কাছে নিজের বিশ্বাত্মারূপে আবির্ভূত হলেন এবং মহাঋষিকে জানালেন, যে অচিরেই জল নেমে গিয়ে ভূমির দেখা মিলবে। এই শ্যামকান্তিযুক্ত শিশু বা বালার স্মরণে প্রলয়ের অন্তে প্রথম সৃষ্ট সেই দ্বীপভূমির নাম হল "শ্যাম বালা দ্বীপ"। এরপর সময়ের বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে সেই দ্বীপময়ভূমি "শামবালা" নগরী নামে পরিচিত হলো।
শামবালা নগরীর বিশেষত্ব
শামবালা নগরীর সর্বত্র দিব্যপ্রেম এবং একাত্মতা বিরাজ করে। এই নগরীর অধিবাসীবৃন্দ সর্বদা দিব্য আলোক বহন করেন। দিব্য আলোক শক্তি তাঁদের জীবনের পরিচালন শক্তি, তাঁদের প্রতিদিনের কর্ম নির্বাহের একমাত্র মাধ্যম। তাঁরা শামবালা নগরীর আইন কানুন এবং রীতিনীতি গভীর নিষ্ঠার সঙ্গে মেনে চলেন। শামবালা নগরীর সর্বত্র দিব্য প্রেম পরিপূর্ণ হয়ে আছে। এখানে কোথাও কোন প্রান্তে কোন অ-প্রেম বা ঘৃণা নেই।এই নগরীর বিশেষত্বই হলো, এখানকার মানুষদের মধ্যে থাকা একাত্মতার বোধ। এঁরা প্রত্যেকে অত্যন্ত জ্ঞানবান ও শক্তিশালী, উচ্চ সৃজনশীল এবং পৃথিবীতে তাঁদের সহায়তা ও কল্যাণ হস্ত প্রসারিত করতে সদাপ্রস্তুত। তাঁরা চিরতরুণ এবং অপূর্ব সৌন্দর্যের অধিকারী। শামবালা নগরী সুবর্ণকান্তিযুক্ত এবং এই নগরে বসবাসকারী অধিবাসীবৃন্দও সুবর্ণকান্তিতে মণ্ডিত। শামবালা নগরীকে মনে করা হয় আদর্শ নগরী, যা সকল প্রকার নেতিবাচকতার প্রভাব থেকে মুক্ত। শামবালা নগরীর চতুর্দিকে একটি অতি শক্তিশালী সুরক্ষা বলয় রয়েছে, যেটির উপস্থিতির কারণে তিলমাত্র নেতিবাচকতা এই নগরীর কাছে ঘেঁষতে পারে না।
একমাত্র আত্ম-সাক্ষাৎকার প্রাপ্ত ব্যক্তিগণের জন্যই শামবালা নগরীর তোরণদ্বার উন্মুক্ত হয়ে থাকে। শামবালা সমস্ত চিরঞ্জীবী বা অমর ব্যক্তিগণের জন্য সংরক্ষিত। কেউ কেউ বিশ্বাস করেন, কৈলাস- শামবালা নগরীর প্রবেশদ্বার। এই সংরক্ষিত পূত-পবিত্র শক্তিশালী তপোস্থলীতে প্রবেশ-ক্ষমতা লাভ করার জন্য অনেক তিব্বতীয় সাধককে পরিক্রমার সময়, "অওম (AUM) মণিপদ্মে হুম" মন্ত্রোচ্চারণ করতে দেখা যায়।
শামবালায় প্রবেশ-প্রাপ্তির ক্ষমতা
আধ্যাত্মিক সাধক থেকে আরম্ভ করে বিদ্বান পন্ডিতের কাছেও শামবালা নগরীতে প্রবেশের পথ অনুসন্ধান করা, সবচেয়ে ঈপ্সিত বিষয় বা চর্চাগুলির একটি। পৃথিবীতে যাপিত জীবনের মোহ যত বৃদ্ধি পেয়েছে, যত অধর্ম শক্তিশালী হয়েছে, শামবালা নগরী ততই অপ্রাপনীয় হয়ে উঠেছে সাধারণ মানুষের কাছে। শামবালা নগরীর চতুর্দিকে স্তরে স্তরে আলো এবং শক্তিশালী তেজপ্রভার দুর্ভেদ্য বলয় ততই সুরক্ষিত করেছে শামবালা নগরীকে। শামবালা নগরীতে কেউ যদি আর প্রবেশ করতে নাও পারে তাতেও কিছু যায় আসে না। যখন কোন ব্যক্তি তার অস্তিত্বের প্রতিটি স্তরে পবিত্রতম হয়ে ওঠে, একমাত্র তখনই সে শামবালা নগরীতে প্রবেশের অধিকারী হয়। পাশাপাশি এও সত্য যে শামবালা নগরীতে কেউই পার্থিব শরীরে কিংবা সূক্ষ্ণদেহে ততক্ষণ পর্যন্ত প্রবেশ করতে ব্যর্থ হবে, যতক্ষণ না সেখানে প্রবেশের কোন বিশেষ অভিপ্রায় থাকবে অথবা সেখান থেকে কোনো দিব্য আহ্বান আসবে। শামবালা নগরীতে কোন অবস্থাতেই যথেচ্ছ প্রবেশাধিকার থাকেনা। শামবালা নীতি অত্যন্ত সুকঠোর এবং এই নগরীর তোরণদ্বার দৃঢ়ভাবে আবদ্ধ।
শামবালা কোন ধর্মের নিজস্ব নয়। আমরা এই পার্থিব জগতে বাস করেও শামবালা জগতের নিয়ম অনুসরণ করে শামবালার অধিবাসী হয়ে উঠতে পারি। পৃথিবীতে মানুষ যত বেশি নিজেকে সত্যাশ্রয়ী রূপান্তরের পথে আনতে পারবে, ততই শামবালা এবং আমাদের এই পার্থিব জগতের ব্যবধান কমে আসবে। সমগ্র পৃথিবী হয়ে উঠবে শামবালার পথ, যা আমাদের সুবর্ণযুগ বা সত্যযুগে পৌঁছে দেবে। সত্যযুগে, সমগ্র পৃথিবী হয়ে উঠবে 'শামবালা'।
আমাদের অনুসরণ করুন
সমস্ত কোটেশন দেখতে ...