ব্রহ্মজ্ঞান
ব্রহ্মজ্ঞান হল সৃষ্টি সম্বন্ধে সম্পূর্ণ জ্ঞান; জ্যোতি (Light), পঞ্চতত্ত্ব, ত্রিগুণসমূহ, আত্মা, ১৪তল, পঞ্চকোষ, সপ্তচক্র, ধর্মের নীতি, কর্মের নীতি, মুক্তইচ্ছা বা স্বাধীন-ইচ্ছা (Free Will), মোক্ষ ইত্যাদি সম্পর্কে পরিপূর্ণ বিদ্যাই হল ব্রহ্মজ্ঞান। এই জ্ঞানের আলোয় আমরা আমাদের জীবন সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা সহযোগে উদ্দেশ্যপূর্ণ একটি ইতিবাচক জীবনযাপন করতে সক্ষম হই।
অনাদি অব্যক্তের স্তর থেকে এক অনন্ত জ্যোতি-সমুদ্র উৎসারিত হয়ে সৃষ্টির প্রথম প্রকাশ ঘটায়। অনন্ত জ্যোতি-প্রকাশ থেকে এক মহাসমুদ্রব্যাপ্ত চৈতন্যপুঞ্জের সৃষ্টি হয়। সেই মহাচৈতন্য থেকেই মহাবিশ্বের আবির্ভাব। আলোই ঈশ্বর।
জ্যোতির্লোকই(Plane of Light) হল পরব্রহ্ম লোক। পরমব্রহ্ম থেকে যখন চৈতন্যের সৃষ্টি হল, তখন তা ছিল অনেকটা বুদবুদের মতন, যা সৃষ্টি হচ্ছিল এবং ভেঙে যাচ্ছিল। মহাচৈতন্য নিজেকে পুরুষ এবং নারী এই দুই শক্তিতে বিভাজিত করল। পুরুষ অংশটি অপরিবর্তিত রূপে অবস্থান করতে লাগলো। নারী অংশটির থেকে দেবী লোকের সৃষ্টি হল।
পুরুষ এবং নারী শক্তির সম্মিলিত প্রভাবে তিনটি দিব্যলোক সৃষ্টি হল, যথা শিবলোক, বিষ্ণুলোক এবং ব্রহ্মলোক। তিনটি প্রধান কাজের ভার যথা সৃষ্টি, স্থিতি এবং ধ্বংস তিনজন দিব্য ব্যক্তিত্বের উপর আরোপিত হল, যথা ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং মহেশ্বর।
জ্যোতি থেকেই সৃষ্টির উৎস। সমগ্র সৃষ্টি পাঁচটি উপাদানে গঠিত, যাদেরকে বলা হয় পঞ্চভূত। এগুলি হল আকাশ (Ether), বায়ু (Air), অগ্নি (Fire), জল (Water)এবং পৃথিবী (Earth)। সমগ্র সৃষ্টিতে তিনটি গুণ বর্তমান, যাদেরকে ত্রিগুণ বলা হয়, যথা সত্ত্ব, রজঃ এবং তমঃ।
শ্রীব্রহ্মদেব ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টিকর্তা। ব্রহ্মাণ্ড হল বস্তুজাগতিক সৃষ্টিলোক (Material Cosmos), যা অসংখ্য নক্ষত্রপুঞ্জ, তারকারাজি, গ্রহ নিয়ে গঠিত। সেখানে প্রাণের প্রকাশের মধ্য দিয়ে সৃষ্টির বিচিত্র রূপ প্রকাশিত হল। জাগতিক মহাবিশ্ব ১৪টি তল বা লোক নিয়ে গঠিত। প্রথম তল বা লোক আধ্যাত্মিকভাবে সবচেয়ে সমৃদ্ধ এবং ১৪তম তল সবচেয়ে বেশি ভোগাকাঙ্খী।
আমরাই আত্মা। আমরা জীবাত্মাগণ পরব্রহ্মলোকে ছিলাম, ঠিক যেন অসীম আলোক সমুদ্রের এক-একটি অংশ। আমাদের এবং ঈশ্বরের অনুভূতির মধ্যে কোন ভেদ ছিল না। আমরা ঈশ্বরের মতোই পূতপবিত্র ছিলাম এবং তাঁর সকল গুণ এবং ক্ষমতা আমাদেরও ছিল। প্রেম এবং আনন্দই ছিল আমাদের প্রকৃত বৈশিষ্ট্য।
মুক্ত-ইচ্ছা হলো আত্মার নিজস্ব পছন্দের বিলাসিতা। যখন ঈশ্বর দিব্যবিশ্ব (Divine Cosmos) এবং বস্তুবিশ্ব (Material Cosmos) সৃষ্টি করলেন , তখন আমাদের সেই সৃষ্টিকে প্রত্যক্ষ করার আকাঙ্ক্ষা জন্ম নিল। ঈশ্বর আমাদের সতর্ক করেছিলেন যে, আমাদের আকাঙ্ক্ষা যদি সীমার বাইরে চলে যায়, তবে আমরা সেই বস্তু জগতেই আটকে থাকবো। এবং সেই সঙ্গে তিনি আমাদের এও বলেছিলেন যে, কখনোই তিনি আমাদের মুক্তইচ্ছার (Free Will) মাঝখানে এসে দাঁড়াবেন না।
মুক্ত-ইচ্ছা হলো আত্মার নিজস্ব পছন্দের বিলাসিতা। যখন ঈশ্বর দিব্যবিশ্ব (Divine Cosmos) এবং বস্তুবিশ্ব (Material Cosmos) সৃষ্টি করলেন , তখন আমাদের সেই সৃষ্টিকে প্রত্যক্ষ করার আকাঙ্ক্ষা জন্ম নিল। ঈশ্বর আমাদের সতর্ক করেছিলেন যে, আমাদের আকাঙ্ক্ষা যদি সীমার বাইরে চলে যায়, তবে আমরা সেই বস্তু জগতেই আটকে থাকবো। এবং সেই সঙ্গে তিনি আমাদের এও বলেছিলেন যে, কখনোই তিনি আমাদের মুক্তইচ্ছার (Free Will) মাঝখানে এসে দাঁড়াবেন না।
পঞ্চকোষসমূহ
দিব্যলোকের মধ্যে দিয়ে আমাদের যাত্রার সময়ই আমরা বিশেষ ধরনের কোষপ্রাপ্ত হয়েছিলাম।
এই পৃথিবীতে পৌঁছোবার পরেই আমরা আমাদের পার্থিব দেহটি পাই।
এই পাঁচটি কোষ হল অন্নময় কোষ (Physical Body), প্রাণময় কোষ (Vital Body), মনোময় কোষ (Mind Body), বিজ্ঞানময় কোষ (Intellectual Body) এবং আনন্দময় কোষ (Spiritual Body) ।
যখন কোনো আত্মা, ব্রহ্মাণ্ড বা বস্তুবিশ্ব (Material Cosmos) থেকে অবতরণ করতে আরম্ভ করে, তখন সপ্তম-লোক অর্থাৎ আমাদের পৃথিবী বা ভূ-লোকে উপনীত হতে তাকে সত্যলোক, তপোলোক, জনলোক, মহর্লোক, স্বর্লোক এবং ভূবর্লোকের মধ্যে দিয়ে অবতরণযাত্রা সংঘটিত করতে হয় এবং অবশেষে সেই আত্মা আমাদের পৃথিবী অর্থাৎ ভূ-লোকে এসে উপনীত হয়।
এই অবতরণ যাত্রার সময় প্রত্যেক নির্দিষ্ট লোকের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে আমাদের মননময় কোষের সঙ্গে এক একটি শক্তিশালী শক্তিযন্ত্র বা শক্তিচক্র (Chakras) সংযুক্ত হতে থাকে। এই সূত্রেই আমাদের দেহে সাতটি শক্তিচক্র বর্তমান, যা এই সুনির্দিষ্ট সাতটি লোকের শক্তি এবং জ্ঞানকে উপস্থাপিত করে। দেহস্থিত শক্তিচক্র সক্রিয় হলে তা হয়ে ওঠে, সুনির্দিষ্ট সেই চক্রের সঙ্গে সংযুক্ত স্তর বা লোকের জ্ঞান এবং শক্তি প্রাপ্তির সিংহদুয়ার। শক্তি সঞ্চয়ের আধার হিসেবেও দেহস্থিত শক্তিচক্রের অনন্য গুরুত্ব রয়েছে।
এই সাতটি চক্র হল যথাক্রমে সহস্রার চক্র, আজ্ঞাচক্র, বিশুদ্ধিচক্র, অনাহতচক্র, মনিপুরচক্র, স্বাধিষ্ঠানচক্র এবং মূলাধারচক্র। এই প্রত্যেকটি চক্র প্রকৃতপক্ষে বিভিন্ন উচ্চতর তল বা লোকে আত্মার প্রবেশ বা নির্গমন পথ নির্দেশ করে।
সপ্তঋষিগণের অবদান
পঞ্চভূতে আবদ্ধ জীবাত্মা তার উৎস সম্পর্কে কিছুই স্মরণ করতে পারে না, কারণ তার অস্তিত্বের উপরে স্তরে স্তরে বিভিন্ন কোষের সুনির্দিষ্ট আবরণ তার চেতনাকে মেঘাচ্ছন্ন করে রাখে। এই অবস্থাকেই বলে অজ্ঞানতা (Ignorance) এবং অহং (Ego)।
জীবাত্মা যতই এই ভূ-লোকের অভিজ্ঞতায় নিজেকে মুড়ে ফেলে, ততই সে মায়ার জালে আবদ্ধ হয়ে যায়, বিভিন্ন ইন্দ্রিয়ের আসক্তি তাকে তার দিব্যআদর্শ (Divine Laws) থেকে বিচ্যুত করে। প্রেম, আনন্দ, শান্তি এবং সম্প্রীতি- যা তার সত্য পরিচয় , তা ভুলিয়ে দেয়।
পার্থিব জীবনের অভিজ্ঞতার ভার ক্রমশ কর্মফল সঞ্চয় করতে আরম্ভ করে। জীবাত্মা তার সকল গুণাবলী ও দিব্যক্ষমতা, যেগুলি একসময় তার নিজেরই অধিগত ছিল, ক্রমশ সেসব সে হারিয়ে ফেলে। দিব্য উৎসের সঙ্গে তার সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়। সেইসঙ্গে নিজের দিব্যপ্রকৃতি থেকেও সে বিযুক্ত হয়ে যায়। জীবাত্মাকে তখন একের পর এক জন্মগ্রহণ করে সেই কর্মফল ভোগের মাধ্যমে কর্মচিহ্নগুলি পরিষ্কৃত করতে হয়, তবুও সে ইহলোকেই আটকে থাকে।
আর এখানেই সপ্তঋষিগণের বিশেষ ভূমিকা এবং দায়িত্ব প্রত্যেক জীবাত্মাকে পথপ্রদর্শন করার। বিশ্বসৃষ্টিকে যথাযথ উপভোগের পর আত্মাকে তার উৎসে ফিরতে হবে- সপ্তঋষিগণের কর্তব্যই হল এই বিষয়ে আত্মাকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া।
মায়ায় আবদ্ধ আত্মাকে কর্মফলের বাঁধন থেকে মুক্ত করতে, পৃথিবীতে জন্ম নেওয়া মহান আধ্যাত্মিক গুরুর মাধ্যমে, সপ্তঋষিগণ বিভিন্ন আধ্যাত্মিক প্রকৌশল প্রদান করেন, যেগুলি কর্মফল এবং কর্মচিহ্নগুলিকে পরিষ্কার করার পদ্ধতি বা উপায়।
চূড়ান্ত স্বাধীনতা অর্জিত হয় তখনই যখন আত্মা তার যাত্রাপথ সম্পূর্ণ করে, এই অবস্থাকে বলে মুক্তি বা মোক্ষ।
একজন গুরু হলেন আধ্যাত্মিক পথপ্রদর্শক। সাধককে কর্মফলের বাঁধন ও জন্ম-মৃত্যুর আবর্তন থেকে নিশ্চিতভাবে মুক্তি দিতে গুরু সামগ্রিক দায়িত্বভার গ্রহণ করেন ও আত্মাকে পথ দেখান। গুরু আমাদের জীবনে আধ্যাত্মিক অভিযাত্রার সূচনা করেন, জীবনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে আমাদের শিক্ষিত করে তোলেন এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি তা হল, আধ্যাত্মিক জীবন এবং বস্তুগত জীবনের মধ্যে একটি ভারসাম্য রক্ষা করে ভালোবাসা, সুখ-শান্তি এবং সমৃদ্ধি ও ইতিবাচকতার সঙ্গে জীবন পরিচালনা করতে আমাদের শিক্ষা দেন।
একজন গুরু হলেন আধ্যাত্মিক পথপ্রদর্শক। সাধককে কর্মফলের বাঁধন ও জন্ম-মৃত্যুর আবর্তন থেকে নিশ্চিতভাবে মুক্তি দিতে গুরু সামগ্রিক দায়িত্বভার গ্রহণ করেন ও আত্মাকে পথ দেখান। গুরু আমাদের জীবনে আধ্যাত্মিক অভিযাত্রার সূচনা করেন, জীবনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে আমাদের শিক্ষিত করে তোলেন এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি তা হল, আধ্যাত্মিক জীবন এবং বস্তুগত জীবনের মধ্যে একটি ভারসাম্য রক্ষা করে ভালোবাসা, সুখ-শান্তি এবং সমৃদ্ধি ও ইতিবাচকতার সঙ্গে জীবন পরিচালনা করতে আমাদের শিক্ষা দেন।
আমাদের অনুসরণ করুন
সমস্ত কোটেশন দেখতে ...